ভাস

ভাসের সময়কাল, ভাস সমস্যা, ভাসের নাটকচক্র, ভাসের শ্রেষ্ঠ নাটক, ভাসের উপাস্য দেবতা

Table of Contents

মহাকবি ভাস

সময়কালখৃস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক
স্থানদক্ষিণভারত
উপাধিঅগ্নিমিত্র
নাটক সংখ্যা১৩ টি
শ্রেষ্ঠ নাটকস্বপ্নবাসবদত্তম্
মহাকবি ভাস

ভাসের সময়কাল

ভাসের সময়কাল নিয়ে পণ্ডিত মহলে অনেক মতপার্থক্য রয়েছে। উইন্টারনিৎসের মতে ভাস অশ্বঘোষ এবং কালিদাসের মধ্যবর্তী সময়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাই খ্রীষ্টীয় ২য় শতকই ভাসের সময়কাল বলে ধরা যেতে পারে।

কালিদাসের নাটকে ভাসের নামোল্লেখ

কালিদাস তাঁর ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম্’ নাটকের প্রস্তাবনায় (প্রথম অংক) প্রতিথযশা ভাসের নামোল্লেখ করেছেন – “প্রথিতযশসাং ভাস-সৌমিল্ল-কবিপুত্রাদীনাং প্রবন্ধানতিক্রম্য কথং বর্তমানস্য কবেঃ কালিদাসস্য কৃতৌ বহুমানঃ?” (প্রথিতযশা ভাস, সৌমিল্ল, কবিপুত্র প্রভৃতি নাট্যকারগণের নাটক অভিনয় না করে কেনই বা অর্বাচীন নাট্যকার কালিদাসের নাটকের প্রতি এত সম্মান দেখানো হচ্ছে?)

বাণভট্টের গ্রন্থে ভাসের নামোল্লেখ

সপ্তম শতকের বাণভট্ট তাঁর ‘হর্ষচরিত’ কাব্যের প্রারম্ভে ভাসের নামোল্লেখ করেছেন।

“সূত্রধারকৃতারস্তৈনটিকৈর্বহুভূমিকৈঃ।

সপতাকৈর্যশো লেভে ভাসো দেবকুলৈরিব।।” (১/১৫)

(স্থপতির দ্বারা নির্মিত পতাকাশোভিত বহুতলবিশিষ্ট সূত্রধার রাজমিস্ত্রীর দ্বারা আরব্ধ দেবমন্দিরের তুল্য, প্রাসঙ্গিক ঘটনাযুক্ত, বহু অংক সমন্বিত নাটকগুলির দ্বারা ভাসের যশ অধিষ্ঠিত)।

জয়দেবের নাটকে ভাসের নামোল্লেখ

‘প্রসন্নরাঘব’ নাটকে জয়দেব ভাসের নামোল্লেখ করেছে – হাসঃ কবিকুলগুরুঃ কালিদাসো বিলাসঃ”। (ভাস হলেন কাব্যলক্ষ্মীর (সরস্বতীর) হাসি, আর কালিদাস হলেন তার “যস্যা ভাসো বিলাস কথা)।

বাক্পতিরাজের কাব্যে ভাসের নামোল্লেখ

‘গউড়বহো’ কাব্যে বাক্পতিরাজ ভাসকে ‘জ্বলনমিত্র’ বা ‘অগ্নিরবন্ধু’ বা ‘অগ্নিপ্রিয়’ বলেছেন।

দণ্ডীর ‘অবন্তীসুন্দরীকথা’ কাব্যে ভাসের নামোল্লেখ

“সুবিভক্তমুখাদ্যসৈর্বক্তলক্ষণবৃত্তিভিঃ।

পরতোঽপি স্থিতো ভাসঃ শরীরৈরিব নাটকৈঃ।।” (ভূমিকা)

(ভাস স্বীয় শরীর সদৃশ নাটকসমূহের দ্বারা মৃত্যুর পরেও অমর হয়ে রয়েছেন।)

রাজশেখরের গ্রন্থে ভাসের নামোল্লেখ

দশম শতকের রাজশেখর তাঁর ‘সুক্তিমুক্তাবলী’ গ্রন্থে বলেছেন –

“ভাসনাটকচক্রেঽপি ছেকৈঃ ক্ষিপ্তঃ পরীক্ষিতুম্।

স্বপ্নবাসবদত্তস্য দাহকোঽভূন্ন পাবকঃ।” (সূক্তিমুক্তাবলী, ৪/৪৮)

(ভাসের নাটক (সমালোচনার) আগুনে দগ্ধ হলেও ‘স্বপ্নবাসবদত্তা’ নাটক সম্পূর্ণ অক্ষত ছিল।)

ভাস-সমস্যা

১৯০৯ থেকে ১৯১১ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে পণ্ডিত তিরুবাগ্রহারম্ গণপতি শাস্ত্রী কেরলের অন্তর্গত তিরুবনন্তপুরমে অবস্থিত ‘পদ্মনাভপুরম্’ অঞ্চলের নিকটস্থ ‘মনলিক্করনাথম্’ নামক স্থান থেকে তালপাতার দুটি পুঁথিতে মালয়ালম্ হরফে লেখা ভাসের ১৩খানি নাটক আবিষ্কার করেন। সেই পাণ্ডুলিপিতে ভাসের নাম না থাকায় পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়। নাটকগুলির রচয়িতা, আবির্ভাবকাল নিয়ে বিভিন্ন মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে। সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে তা ‘ভাস-সমস্যা’ নামে পরিচিত।

১৩টি নাটক ভাসের রচনা

সমর্থক

টি. গণপতি শাস্ত্রী, কীথ, টমাস, পরাঞ্জপে, দেবধর প্রমুখ পণ্ডিতগণ মনে করেন ১৩ খানি নাটক ভাসের রচনা।

যুক্তি

যুক্তিগুলি হল –

  • ১. কোন নাটকেই নাট্যকারের নাম নেই।
  • ২. কোন নাটকেই নান্দী শ্লোক নেই।
  • ৩. ‘নান্দ্যস্তে ততঃ প্রবিশতি সূত্রধারঃ’ এই বাক্য দিয়ে নাটকগুলির আরম্ভ হয়েছে।
  • ৪. ‘প্রস্তাবনা’ শব্দের পরিবর্তে নাটকে ‘স্থাপনা’ শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে।
  • ৫. প্রায় সব নাটকে একই রকম প্রাকৃত ভাষার ব্যবহার করা হয়েছে।
  • ৬. ‘রাজসিংহঃ প্রশাস্তু নঃ এইরকম ভরতবাক্য প্রায় সব নাটকেই দেখা যায়।
  • ৭. এক নাটকের সঙ্গে অন্য নাটকের সাদৃশ্য।
  • ৮. নাট্যশাস্ত্রের নীতি বিরুদ্ধ নাট্যকৌশলের প্রয়োগ। (যেমন মঞ্চে যুদ্ধ, মৃত্যু প্রভৃতি দৃশ্যের উপস্থাপনা)

১৩টি নাটক ভাসের রচনা নয়

সমর্থক

বার্গেট, জনস্টন, পিসারোতি প্রমুখ পণ্ডিতগণ মনে করেন ১৩টি নাটক ভাসের রচিত নয়।

যুক্তি

এই প্রসঙ্গে যুক্তি হল –

  • ১. এই নাটকগুলি সম্ভবত কেরল অঞ্চলের ভ্রাম্যমান চকিয়ার নাট্যসম্প্রদায় কর্তৃক রচিত।
  • ২. ‘নান্দ্যতে…..’ এই তথাকথিত প্রাচীন রীতি কেবল এই আবিষ্কৃত নাটকগুলির বৈশিষ্ট্য নয়। এই রীতি শূদ্রকের ‘পদ্মপ্রাভৃতক’ নাটকেও দেখা যায়।
  • ৩. প্রাচীন ‘স্বপ্নবাসবদত্তম্’ নাটকের সঙ্গে অধুনাপ্রাপ্ত ‘স্বপ্নবাসবদত্তম্’ নাটকের সর্বাংশে মিল পাওয়া যায় না।
  • ৪. ১৩টি নাটকের প্রস্তাবনায় নাট্যকারের নাম নির্দেশ নেই এবং দক্ষিণ ভারতীয় নাটকে ‘প্রস্তাবনার’ পরিবর্তে ‘স্থাপনা’ শব্দটির ব্যবহৃত হত।

সিদ্ধান্ত

উল্লিখিত তথ্য ও যুক্তিসমূহের ভিত্তিতে গণপতিশাস্ত্রী মহোদয় দাবি করেন আবিষ্কৃত রচনাগুলি একই ব্যক্তির দ্বারা রচিত এবং রচয়িতা আর কেউ নন, তিনি হলেন কালিদাসাদির দ্বারা প্রশংসিত নাট্যকার ভাস।

ভাসের নাটকচক্র

ভাসের নাটকসমূহকে ‘ভাস-নাটকচক্র’ বলেছেন রাজশেখর। বিষয়বস্তু অনুসারে ভাসের ১৩টি নাটককে ৪টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে –

১। রামায়ণমূলক

প্রতিমা, অভিষেক ও যজ্ঞফল।

২। মহাভারতমূলক

দূতবাক্য, দূতঘটোৎকচ, কর্ণভার, মধ্যমব্যায়োগ, উরুভঙ্গ, পঞ্চরাত্র ও বালচরিত।

৩। বৃহৎকথাশ্রিত

প্রতিজ্ঞাযৌগন্ধরায়ন ও স্বপ্নবাসবদত্তা।

৪। লোককথাশ্রিত

অবিমারক ও চারুদত্ত

ভাসের উপাস্য দেবতা

ভাস বিষ্ণুর উপাসক ছিলেন এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও আচার ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিলেন।

পতাকা স্থানের প্রয়োগকর্তা

ভাস পতাকা স্থানের সার্থক প্রয়োগকর্তা ছিলেন। উদাহরণ – ‘স্বপ্নবাসবদত্তম্’নাটকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় অঙ্ক।

ভাসের নাটকচক্রের কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য

  • ১. বেশির ভাগ নাটকই একাঙ্ক। সমস্ত একাঙ্ক নাটক মহাভারত অবলম্বনে রচিত।
  • ২. ভাস হলেন একমাত্র বিয়োগান্তক নাটকের রচয়িতা। (ঊরুভঙ্গ)
  • ৩. স্বপ্নবাসবদত্তম্, অবিমারক, চারুদত্ত নাটক ব্যতীত কোনো নাটকেই বিদূষক চরিত্র নেই।
  • ৪. অগ্নির প্রয়োগ নাটকে অধিক পরিমাণে লক্ষিত হয়।
  • ৫. নাট্যশাস্ত্রের পরিপন্থী দৃশ্যগুলি দেখানো হয়েছে। যেমন – ‘অভিষেক’ নাটকের মঞ্চে বালিবধ; ‘উরুভঙ্গ’তে যুদ্ধদৃশ্য ও মৃত্যুদৃশ্য।
  • ৬. ভাসের নাটকে ‘পতাকাস্থানের’ সার্থক প্রয়োগ করা হয়েছে। (কোন একটি বিষয়ে চিন্তা করতে করতে তৎসংলগ্ন অপর একটি ভাবের সূচনা অতর্কিতে ঘটলে পতাকাস্থান হয়।)।

ভাসের শ্রেষ্ঠ নাটক

রাজশেখর রচিত ‘সূক্তিমুক্তাবলীতে’ বলা হয়েছে ভাসের সকল নাটকের মধ্যে ‘স্বপ্নবাসবদত্তম্’ নাটকটি শ্রেষ্ঠ নাটক।

রামায়ণমূলক শ্রেষ্ঠ নাটক

ভাসের রামায়ণমূলক শ্রেষ্ঠ নাটক হল ‘প্রতিমা নাটক।

ভাসের নাট্য বৈশিষ্ট্য

ভাসের নাট্য বৈশিষ্ট্য হল অনাড়ম্বর ভাষা, সংক্ষিপ্ত নাট্য সংলাপ, নাটকে অগ্নির বেশি ব্যবহারে তিনি অগ্নিপ্রিয়, চরিত্রচিত্রণে সিদ্ধহস্ত, সারগর্ভ সহজ সরল বাক্য প্রয়োগ, নাটকের গতিবেগ সৃষ্টি ক্ষমতা, দীর্ঘ সমাস ও দুর্বোধ্য ভাষা বর্জন, ছন্দ ও অলংকারের সংযম, সাধারণ বিষয় অবলম্বনে রস প্রকাশে দক্ষতা।

ভাসের মোট একাঙ্ক নাটকের সংখ্যা

ভাসের একাঙ্ক নাটকগুলি হল (৩) দুতঘটোৎকচ (৪) কর্ণভার (৫) মধ্যমব্যায়োগ। (১) উরুভঙ্গ (২) দূতবাক্য

শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী ভাসের নাটকসমূহ

ভাস রচিত ১৩টি নাটকের মধ্যে –

ব্যায়োগ শ্রেণির নাটক

৩টি। যথা- কর্ণভার, দূতবাক্য ও মধ্যমব্যায়োগ।

নাটক শ্রেণির নাটক

৪টি। যথা- প্রতিমা, অভিষেক, বালচরিত ও স্বপ্নবাসবদত্তা।

প্রকরণ শ্রেণির নাটক

৩টি। যথা- অবিমারক, চারুদত্ত ও প্রতিজ্ঞাযৌগন্ধরায়ণ।

উৎসৃষ্টিকাঙ্ক শ্রেণির নাটক

২টি। যথা – ঊরুভঙ্গ ও দূতঘটোৎকচ। সমবকার শ্রেণির নাটক ১টি। যথা – পঞ্চরাত্র।

ভাস কালিদাসের পূর্ববর্তী নাট্যকার

এতদ বিষয়ে দুটি যুক্তি-

  • ১। কালিদাস স্বয়ং তাঁর মালবিকাগ্নিমিত্রম্ নাটকে অন্যান্যদের সঙ্গে ভাসের নামোল্লেখ করেছেন – “প্রথিতযশসাং ভাসসৌমিল্লা…..’
  • ২। ভাসের ব্যবহৃত প্রাকৃত ভাষা কালিদাসের ব্যবহৃত প্রাকৃতভাষা থেকে প্রাচীনতর এবং ভাসের নাট্যভাষায় অপাণিনীয় পদের প্রয়োগ আছে।

প্রাক্ কালিদাস যুগের ভাস রচিত রামায়ণমূলক নাটক

২ টি- (১) প্রতিমানাটক, (২) অভিষেকনাটক।

প্রাক্ কালিদাস যুগের ভাস রচিত মহাভারতমূলক নাটক

ভাস রচিত- (১) পঞ্চরাত্র (২) উরুভঙ্গ।

গ্রাম্যচিত্র কল্পনা অবলম্বনে ভাস রচিত নাটক

ভাসের রচিত ‘বালচরিত’ এবং ‘পঞ্চরাত্র’ নাটক দুটিতে গ্রাম্যচিত্র কল্পনার সাদৃশ্য রয়েছে।

নাট্যশাস্ত্রের নিয়ম বিরুদ্ধ ভাসের নাটক

  • ১। অভিষেক- মঞ্চে বালির মৃত্যু।
  • ২। বালচরিত- মঞ্চে অরিষ্টের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের যুদ্ধদৃশ্য এবং মৃত্যুদৃশ্য প্রদর্শিত।
  • ৩। প্রতিমা- মঞ্চের উপর দশরথের মৃত্যু।
  • ৪। উরুভঙ্গ- মঞ্চে রাজা দুর্যোধনের মৃত্যু।
  • ৫। স্বপ্নবাসবদত্তা- মঞ্চে শয়নদৃশ্য বা নিদ্রা দৃশ্যের অবতারণা।

জেনে রাখা ভালো

যজ্ঞফল- ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে পণ্ডিত কালিদাস শাস্ত্রী কাথিয়াওয়াড় থেকে একটি পুঁথি সংগ্রহ করেন। এই পুঁথিতে ‘যজ্ঞফল’ নামক একখানি নাটক আবিষ্কৃত হয়। ভাসের নাটচক্রের সঙ্গে সবিশেষ সাদৃশ্য থাকায় গবেষকগণ এটিকে ভাসেরই রচনা বলে মনে করেন।

আলোচ্য নাটকটি ছয় অঙ্কে বিরচিত। তবে এতে ‘নির্বহনাঙ্ক’ নামে একটি সামার বিকৃত রামায়ণের ‘বালকাণ্ডের’ কাহিনি অবলম্বনে রচিত এই নাটকে যজ্ঞানুষ্ঠানের ফলস্বরূপ দশরথ কর্তৃক পুত্রসন্তান প্রাপ্তির কথা বিকৃত হয়েছে। ‘যজ্ঞফল’ নামকরণটিও ঐ হিসাবে সার্থক।

(FAQ) মহাকবি ভাস সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. মহাকবি ভাসকে ‘জ্বলনমিত্র’ বলার কারণ কি?

ভাসের বেশ কিছু নাটকে আকস্মিক অগ্নির ব্যবহার (অগ্নিকাণ্ডের প্রসঙ্গ) লক্ষ্য করা যায় বলে বাক্‌পতিরাজ ভাসকে ‘জ্বলনমিত্র’ বলেছেন।

Leave a Comment